সিলেট, (এবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজ ২৪.কম) : মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, বঙ্গবীর জেনারেল মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর ৩৯তম মৃত্যু-বার্ষিকী আজ।
জাতির এ কৃতি সন্তানের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার জন্মস্থান সিলেটসহ দেশের বিভিন্নস্থানে নানা কর্মসুচীর আয়োজন করা হয়েছে। বঙ্গবীর ওসমানী স্মৃতি সংসদ সিলেটের পক্ষ থেকে আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সিলেটে খতমে কোরআন, বাদ যোহর হযরত শাহজালাল (রহ:) দরগাহ জামে মসজিদে মিলাদ মাহফিল ও দোয়া এবং বঙ্গবীর ওসমানীর মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মরহুমের কবর জিয়ারত করা হয়।
১৭ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বাদ জুম্মা ওসমানীনগর উপজেলার দয়ামীরস্থ বঙ্গবীর এম.এ.জি ওসমানী গণগ্রন্থাগর ও স্মৃতি জাদুঘরে আলোচনা সভা ও সুবিধা বঞ্চিত মহিলাদের মধ্যে সেলাই মেশিন বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বঙ্গবীর ওসমানী স্মৃতি সংসদ সিলেটের সভাপতি সৈয়দ আহমদ বহলুল এতথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী ১৯১৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর একটি মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন । ওসমানীর পৈতৃক নিবাস বর্তমান সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলাধীন দয়ামীর গ্রামে। ওসমানীর পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ও মাতা জোবেদা খাতুন ছিলেন দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক ও জননী। এরমধ্যে ছিলেন ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। শৈশবে ওসমানীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকেই। কোনো স্কুলে ভর্তি না হয়ে, ঘরে বসে বসেই তার বিদুষী মায়ের অনুশাসন এবং যোগ্য গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে বাংলা ও ফার্সি ভাষায় ওসমানী প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯২৯ সালে ১১ বছর বয়সে ওসমানীকে আসামের গৌহাটির কটনস স্কুলে ভর্তি করা হয়। কটন স্কুলে পড়াশুনা শেষ করার পর মায়ের ইচ্ছায় ১৯৩২ সালে সিলেট সরকারী পাইলট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। এই স্কুল থেকে ১৯৩৪ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন এবং ইংরেজীতে কৃতিত্বের জন্য “প্রিটোরিয়া অ্যাওয়ার্ড” লাভ করেন।
১৯৩৪ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি ১৯৩৬ সালে আই.এ পাশ করেন। ১৯৩৮ সালে বি.এ পাশ করেন।
১৯৩৯ সালে ভূগোলে এম এ প্রথম পর্ব পড়ার সময় বৃটিশ-ভারতীয় সেনা বাহিনীতে যোগদান করেন। ছাত্র হিসাবে সব সময়ই ওসমানী অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। ন্যায়পরায়ণতা, শৃংখলা এবং কর্তব্যপরায়ণতা তার চারিত্রিক গুণাবলী বিশেষভাবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ছাত্রজীবনেই ওসমানীর মধ্যে ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের ছাপ ফুটে ওঠে। যোগ্যতার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউ.ও.টি.সি’র (ইউনিভার্সি্িট অফিসার্স ট্রেনিং কোর) সার্জেন্ট নিযুক্ত হন। ওসমানী ১৯৩৯ সালে জুলাই মাসে বৃটিশ-ভারতীয় সেনা বাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি ১৯৪০ সালে ৫ অক্টোবর দেরাদূন সামরিক একাডেমি হতে সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে আর্মির কিং কমিশন প্রাপ্ত হন। ১৯৪১ সালে ১৭ই ফেব্রুয়ারি ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং যোগ্যতার বলে তিনি ১৯৪২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ আর্মির সর্ব কনিষ্ট মেজর হন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে একটি ব্যাটোলিয়ানের অধিনায়ক হয়ে নজীরবিহীন রেকর্ড সৃষ্টি করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বার্মার রণাঙ্গনে স্বতন্ত্র যান্ত্রিক পরিবহনে এক বিশাল বাহিনীর অধিনায়কত্ব দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৫ সালে ওসমানী তার পিতার ইচ্ছা পূরণে আই.সি.এস পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। ১৯৪৭ সালে বৃটেন ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা প্রদান করলে, একই সালে ১৪ ও ১৫ই আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বতন্ত্র দেশ বিশ্ব মানচিত্রে আবির্ভূত হয়। ১৯৪৭ সালে ৭ অক্টোবর লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ১৯৪৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে পি.এস.সি ডিগ্রী লাভ করেন। ওসমানীকে ১৯৫৫ সালে ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনা সদর অপারেশন পরিদপ্তরে জেনারেল স্টাফ অফিসার নিয়োগ করা হয়। এখানে তাকে ১৯৫৬ সালে ১৬ মে মাসে কর্ণেল পদে পদোন্নতি প্রদান করে ডেপুটি ডাইরেক্টর এর দায়িত্বে নিয়োগ করা হয়। এ-সময় আন্তর্জাতিক সংস্থা সিয়াটো ও সেন্টোতে ওসমানী পাকিস্তান বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে ওসমানীর দক্ষতার সংগে ডেপুটি ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনের দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্ণেল পদে কর্মরত থাকাকালীন ওসমানী একজন স্বাধীন চেতা বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কর্নেল পদে থাকা অবস্থায় অবসরে যান ওসমানী। পরবর্তীকালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন ওসমানী। তিনি ১৯৭০ এর নির্বাচনে ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন ওসমানী। মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে পালন করেন অতুলনীয় ভূমিকা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল ওসমানী।
১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ৬৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। সিলেটে হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজার সংলগ্ন গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।